3rd Apr, 2023 | Zakaria Mohammad
Dr M Abdus Salam Azadi
ভুমিকাঃ
রমাদ্বান কে আল্লাহ তাআলা আমাদের জন্য এক অনুপম উপহার হিসেবে পাঠায়েছেন। উম্মাতে মুহাম্মাদিয়ার একাধিক চাহিদা তিনি এই মাসের মাধ্যমে পূরণ করেছেন। আমাদের নবী (সা) এই উম্মাতের বয়স হবে ৬০ থেকে ৭০ বছরের মধ্যে- বলে জানায়েছেন। কিন্তু তাদের কাজ হবে অনেক বড়, অনেক বিস্তৃত এবং অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহ তাদেরকে شهادة على الناس এর দ্বায়িত্ব দেবেন কিয়ামতে। এর অর্থ তারা সকল মানুষের আমলের সাক্ষী হবে, এবং সমস্ত নবীগণ দ্বায়িত্ব পালন করেছে কিনা তার ও সাক্ষ্য দেবে উম্মাতে মুহাম্মাদি। আমি মনে করি, আল্লাহ আমাদেরকে এই রমাদ্বান দিয়ে সেই দ্বায়িত্ব আঞ্জাম দেবার যোগ্য করে গড়ে তুলতে চেয়েছেন। রমাদ্বানের মাধ্যমে আমাদের মান বৃদ্ধি হবে দুই ভাবেঃ
একঃ এই মাসে প্রতিটি আমলের সাওয়াব অনেকগুণ বৃদ্ধি করা হয়। কখনো দশগুণ বাড়ে, কখনো সত্তরগুণ, আবার কখনো সাত শতগুণ বাড়তে পারে। এমনকি কিছু কিছু আমলের প্রতিদান হিসেবেরও বাইরে চলে যায়। সেখানে আল্লাহ নিজেই বলেই দেন, “আমিই তার প্রতিদান হয়ে যাবো”।
দুইঃ কারো জীবনে লাইলাতুল ক্বাদর এলে তো অনেক বড় সৌভাগ্যের প্রতীক হয়ে যায়। কারণ ঐ রাতের মর্যাদা হাজার রাতের চেয়েও বেশি। এর মানে, একজন যদি তার জীবনে ষাট সত্তর বার এই রাত পায়, তা হলে তার আমল, কয়েক হাজার বছর হায়াত প্রাপ্ত ব্যক্তির আমলের কাছাকাছি চলে যায়।
আল্লাহ তাআলা দ্বিতীয় হিজরিতে রামাদ্বানের রোযা ফরদ্ব করেন। কেন এই একটি মাস সিয়াম ফরদ্ব করলেন তা ফুটে উঠেছে তাঁর ভাষায়ঃ
يُرِيدُ ٱللَّهُ بِكُمُ ٱلْيُسْرَ وَلَا يُرِيدُ بِكُمُ ٱلْعُسْرَ وَلِتُكْمِلُوا۟ ٱلْعِدَّةَ وَلِتُكَبِّرُوا۟ ٱللَّهَ عَلَىٰ مَا هَدَىٰكُمْ وَلَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ
অর্থাৎ আল্লাহ চান তোমাদের জন্য সহজ করবেন, তিনি তোমাদের জন্য কঠিন করতে চান না। তিনি চান তোমরা যেন ইদ্দাহ (কোর্স) পূর্ণ করতে পারো, এবং হেদায়াত পাওয়ার কারণে তোমরা আল্লাহর মাহাত্ম্য প্রকাশ করো। আর এভাবে তোমাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ সম্ভব হতে পারে।
যদিও অনেক মুফাসসিরিন মনে করেন এই ৪টা কারণ আল্লাহ তাআলা অসুস্থ ও মুসাফিরের ভাঙা-রোযা অন্য মাসে আদায় করার করণ হিসেবে বর্ণনা করেছেন, কিন্তু ইমাম কুরতুবির (র) বক্তব্যকে আমি প্রাধান্য দিয়েছি। তিনি রমাদ্বানের রোযা ফরদ্ব হওয়ার কারণ হিসেবে এই ৪ টা বিষয় বলা হয়েছে বলে একটা মত উল্লেখ করেছেন।
ত্রিশটা দিন এক নাগাড়ে সিয়াম পালনে দেহ ও মনে, পরিবার ও সমাজে, রাস্ট্র ও বিশ্বে একটা পরিবর্তন আসে, অথবা বলতে পারেন একটা নতুনত্ব আসে। এতে করে অবশেষে আভাসে অভ্যাসে, কথায় কাজে, লেন দেনে অথবা প্রাপ্তিতে বা গ্রহনে এক অপার্থিব শক্তি ও পবিত্রতা তৈরি হয়। আমার বিশ্বাস মূসা (আ) এর ত্রিশ দিনের সিয়াম সাধনা সেই ধরণের ই একটা কোর্স ছিল। আর নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট কোর্স করাটাকে আমরা “তারবিয়াহ বা প্রশিক্ষণ” নাম দিতে পারি।
প্রশিক্ষণ (তারবিয়াহ) এর ইসলামি ধারণাঃ
تَرْبِيَةٌ শব্দের ব্যবহার ইসলামের সেই প্রথম যুগ থেকেই চলে আসছে। এটাকে অধুনা সময়ে ‘প্রশিক্ষণের’ অর্থে নেয়া যায়। তারবিয়া শব্দটি যদি (ربو) এর মূল ধাতু থেকে নেয়া হয়, তাহলে তার অর্থ হবে বৃদ্ধি পাওয়া। যদি (ربي ) মূল ধাতু থেকে হয় তাহলে অর্থ হবে বড় করে তোলা। আর যদি (رَبَّ) মূলানুগে পড়া হয় তাহলে অর্থ হতে পারে সংস্কার করা, অথবা শক্ত করে গড়ে তোলা। অর্থের এই তিনটি প্রপঞ্চ সামনে রেখে ইমাম বায়দ্বাওয়ী (র) তারবিয়ার সংজ্ঞায় বলেনঃ
هي تبليغ الشيء إلى كماله شيئا فشيئا
অর্থাৎ কোন জিনিষকে এক এক করে তার পূর্ণতায় পৌঁছানোকে তারবিয়াহ বা প্রশিক্ষণ বলে।
ইমাম আর-রাগেব বলেনঃ
هو إنشاء الشيء حالا فحالا إلى حد التمام
অর্থাৎ কোন জিনিষকে বিভিন্ন পর্যায়ের মধ্য পূর্ণ করে বানানোই হলো তারবিয়াহ।
আমাদের জীবনে রমাদ্বানের যথেষ্ঠ প্রভাব আছে। কুরআনেও রমাদ্বান নিয়ে বর্ণিত হয়েছে বেশ কয়েকগুলো আয়াত। হাদীসেও এসেছে অনেক বর্ণনা। এগুলো পড়লে দেখা যায়, রামাদ্বানে আল্লাহ আসমান ও যামিনে অনেক পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করেন। এতে মনে হয় আল্লাহ তাআলা গোটা রমাদ্বান মাসকে আমাদের প্রশিক্ষণের মাস হিসেবে নির্ধারণ করেছেন।
রমাদ্বানের প্রশিক্ষণ পদ্ধতিঃ
গভীরভাবে দেখলে মনে হবে আল্লাহ তিন ভাবে এই মাসে আমাদের জীবনকে সুন্দর করে তুলতে চেয়েছেনঃ
১- ইবাদাতঃ
রমাদ্বানের ইবাদাতগুলো বহুমূখী। এখানে সিয়াম একটা প্রধান ইবাদাত। ইসলামে এটি একটি অন্যতম দীর্ঘ ইবাদাত ও বটে। সিয়াম সম্পর্কে তিনি বলে দিয়েছেন “সুবহ সাদিক্ব” থেকে শুরু করে তা রাত পর্যন্ত তোমরা পূর্ণ করো। এবং এর সাওয়াব অপরিসীম।
তিনি সালাতকে করেছেন এই মাসের জন্য বিশেষ ইবাদাত। আমাদের নবীর (সা) ভাষায়ঃ
مَن قَامَ رَمَضَانَ إيمَانًا واحْتِسَابًا، غُفِرَ له ما تَقَدَّمَ مِن ذَنْبِهِ.
অর্থাৎ যে বিশ্বাস ও আশার সাথে রমাদ্বানের রাত সালাতে কাটায় তার আগের গুনাহ সমূহ মাফ করে দেয়া হবে। তিনি আরো বলেছেনঃ
مَن قَامَ لَيْلَةَ القَدْرِ إيمَانًا واحْتِسَابًا، غُفِرَ له ما تَقَدَّمَ مِن ذَنْبِهِ
অর্থাৎ যে লাইলাতুল ক্বাদর বিশ্বাস ও আশার সাথে সালাতে কাটায় তার আগের গুনাহ সমূহ মাফ করে দেয়া হবে। এতে দেখা যাচ্ছে সালাতেরও “কিয়ামু রামাদ্বান” ও “কিয়ামু লায়লাতিল ক্বাদর” বলে একটা নতুন নাম দেয়া হলো।
তিনি সাদাক্বাহকে এমাসে ঈমানের অনুসঙ্গ করেছেন। মনে হবে সিয়ামের পরিপূর্ণতা বিধায়ক হিসেবেই এসেছে সাদাক্বাহ। রমাদ্বানে দান করা সাদাক্বাহকে নানা নামে পরিচিত করেছেন আল্লাহ তাআলা নিজেই। আমাদের নবীও (সা) এই সাদাকাতগুলোর নানা নাম দিয়েছেন। কোনটার নাম দিয়েছেন “সাদাক্বাতুল ফিতর”, কোনটার নাম আবার “ইত’আ্মুল মিসকীন” (মিসকিনকে খাওয়ানো), কোনটার নাম “ফিদইয়া”, কিংবা কোনটার নাম “কাফফারা, আবার কোনটার নাম রেখেছেন “তাফতীরুস সাই-মীন” (রোযাদারকে ইফতার করানো)।
এই মাসে উমরাহকে করা হয়েছে আমাদের নবীর (সা) সাথে হাজ্জ করার মত সাওয়াবের আমল।
তিনি এই মাসে তাওহীদকে উচ্চকিত করেছেন। ইবাদাতগুলোর সাথে إيمانا واحتسابا শব্দদ্বয় জুড়ে দেয়ায় বুঝা গেছে তাওহিদ এখানে মূল বিষয়। আল্লাহর কাছে দুয়া করার উৎসাহ আল্লাহ আমাদের দিয়েছেন। তবে সাথে সাথে আল্লাহ তাআলা নিজেই فَلْيَسْتَجِيبُوا۟ لِى وَلْيُؤْمِنُوا۟ بِى (অতএব তোমরা আমার ডাকে সাড়া দাও ও আমার প্রতি ঈমান আনো) কথা বলে প্রকারন্তরে তাওহীদেরই ডাক দিলেন। একটা হাদীসে মহানবী (সা) আমাদের রমাদ্বানে তাওহীদের কালিমাহ বেশি বেশি করে পড়তে বলেছেন। হাদীসটির সনদে দূর্বলতা আছে।
এইমাসে আরেক ইবাদাত আল্লাহ তাআলা পরিচিত করেছেন। তার নাম দিয়েছেন ই’তিকাফ। মানে, মসজিদে রমাদ্বানের শেষ দশ দিনে নিজকে আটকে রাখা। এর মাধ্যমে আল্লাহ এমন কিছু মানুষ প্রস্তুত করতে চান যারা দীনের জন্য সব কিছুই ত্যাগ করতে ইচ্ছুক হয়।
দুয়া ও যিকরকে আল্লাহ তাআলা এই মাসে নতুন মাত্রায় এনেছেন। রমদ্বানের সিয়াম পালনের উপকার বর্ণনার পর তিনি আমাদের বলে দিয়েছেন, তিনি আমাদের নিকটে। কাজেই আমরা যেন তাকে বেশি বেশি করে ডাকি, কারণ তিনি যে কোন ডাকেরই সাড়া দেন।
এইভাবে একজন মুমিন রমাদ্বানে অনেক ধরণের ইবাদাতের সম্মুখীন হয়, যা তাকে জাহান্নামের দাও দাও আগুন থেকে রেহায় দিয়ে জান্নাতের সবুজাভ বাগানের দোর গড়ায় নিয়ে আসে। আর এই সব ইবাদাত করতে করতে সে “উতাক্বা’ মিনান নার” (জাহান্নাম থেকে মুক্ত) এর তালিকা ভূক্ত হয়ে যায়।
২- আসমান যমিনের পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জনঃ
রমাদ্বান হাজির হলেই মুমিন হৃদয় জেগে ওঠে। তার দেহেও আসে পরিবর্তন। এর প্রভাব পড়ে সমাজের অনেক কর্মকান্ডে। রাস্ট্রীয় অফিস আদালতেও আসে পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জন।
আল্লাহ অনেক মানুষের মনকে এমন ভাবে জান্নাত মুখী করে দেন যাতে তারা জাহান্নামের উপযুক্ত হয়ে গেলেও “উতাক্বা’ মিনান নার” এ পরিণত হয়ে যায়। তাদের মুখের দূর্গন্ধকে আল্লাহ নিজেই মিশকের ঘ্রাণ হিসেবে গণ্য করেন। রোযাদারের জীবনে তিনি আনন্দের ব্যবস্থা করে দেন। যে আনন্দ সে ইফতারের সময় পায়। রোয়াযাদার তার খাওয়ার মধ্যে পরিবর্তন আনে। খাবার নামও দেয় ভিন্ন ভিন্ন। সিয়াম ভাঙার পর খাদ্যের নাম হয় “ইফতার”। মানে “ভেঙে ফেলা”। এই সময় তার জন্য একটা দুয়া কবুল হয়। শেষ রাতে তার জন্য একটা খাবারের সময় নির্ধারণ হয়, যার নাম ও দেয়া হয় ভিন্ন, “সাহূর”। এবং এই খাবারের মাঝে রাখা হয় স্পেশাল বারাকাহ।
দুনিয়ায় যখন এই সাজ সজ্জা, তখন আল্লাহ জান্নাতের আট টা দরোজা খুলে দেন। রায়্যান, জিহাদ, সালাত, যাকাত , আল-আয়মান , যিকর, ওয়ালিদ আলহাজ্জ- সবগুলোই খুলে দেয়া হয়। এই দরোযাগুলো খুলে দিয়ে তিনি প্রতিটি মুমিনের হৃদয় জান্নাত মুখি করে দেন। ফলে এই মাসে প্রতিটি দরোযার দিকে তারা হাত বাড়িয়ে দেয়। তাদের মনেরও টান জাগে সেই দিকে এগিয়ে যেতে। এই জন্য দেখা যায় ঐ সব আমলের প্রতি তাদের উৎসাহ বৃদ্ধি পায়। জাহান্নামের সকল দরোজা আল্লাহ বন্ধ করে দেন। মারাত্মক শয়তানগুলোকে জিঞ্জিরাবদ্ধ করা হয়।
দুনিয়ায় নিয়োগ করা হয় লক্ষ লক্ষ মালাইকাহ, যাদের কাজ হয় মানুষকে ভালো কাজে উদ্বুদ্ধ করা। আল্লাহ লায়লাতুল ক্বাদরে লক্ষ কোটি মালাইকাহ জিবরীলের নেতৃত্বে পাঠান, যাদের কাজ হয় এক বছরের “আমর” সমূহ বন্টন করা ও জনে জনে সালাম প্রেরণ করা। এই মাসে মালাইকাহর এমন বিরাট সংখ্যা আছে যারা সিয়াম-সাধকদের জন্য দুয়া করে।
৩- আল-কুরআন ও রমাদ্বানঃ
রমাদ্বানকে বিশেষায়িত করার পেছনে আল্লাহ তাআলা আল-কুরআনের নাযিল হওয়াকে বড় কারণ হিসেবে দেখিয়েছেন। কুরআন রামদ্বানে নাযিল হয়েছে, লায়লাতুল ক্বদরে তার আগমন সূচিত হয়েছে, এবং এইজন্যেই এই মাসের আগমনে সিয়াম সাধনার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কুরআন এমন কোন ধর্মগ্রন্থ নয়, যা মানা না মানা কোন মানুষের জন্য “নফল” করা হয়েছে। বরং এটা মানার নির্দেশ দেয়া হয়েছে সকল মানুষকে। যে মানবে সে আল্লাহর পথে থেকে জান্নাতের দিকেই ধাবিত হবে। না মানলে তার জন্য আসবে ক্রান্তিকাল, আসবে বিপদ মুসিবাত।
এমনকি এই দুনিয়ায় অসহনীয় দুঃখ দুর্দশা, আর লাঞ্চনার নিগড় তার অপেক্ষায়। কুরআন তার পাঠককে দেয় অপার অনুগ্রহ, তার গবেষক ও বিশেষজ্ঞকে দেয় অপার মর্যাদা, এবং তার হুকুম আহকাম মুতাবিক চলার মানুষকে দেয় দুনিয়ার সেরা সম্মান ও বিশ্ব নেতৃত্ব। কুরআনের কথা শুনতে হলে, তার ভাষা বুঝতে হলে, তার বন্ধু হতে হলে যে গুণটা অপরিহার্য, তা হলো তাক্বওয়ার গুণ অর্জন করা।
যে সব আমলে তাক্বওয়া অর্জন হয় তার একটা তালিকা কুরআনে আল্লাহ দিয়েছেন। এক্ষেত্রে সিয়ামের মাধ্যমে অর্জিত তাক্বওয়া অত্যন্ত কার্যকর। ফলে কুরআনের সাথে আল্লাহ রমাদ্বানের সিয়ামের অনেকগুলো মিল রেখে দিয়েছেন। কিয়ামতে কুরআনকে ও সিয়ামকে কথা বলার সুযোগ দেবেন আল্লাহ। উভয়েই একজন বান্দাহ সম্পর্কে সাক্ষ্য দেবে আল্লাহর সামনে এবং সুপারিশও করবে।
সিয়ামের সাথে কুরআন তিলাওয়াত ও তাদাব্বুর খুবই সুন্দর ভাবে যায়। এই জন্য আল্লাহর রাসূল (সা) রামাদ্বানে কুরআনের রিভিশান করতেন প্রতিটি দিন। এই সময় জিব্রীল ও আসতেন তার রিভিশানে সাথি হতে।
এমনটাই ঘটতো সালাফে সালেহীনের জীবনে। তারা এই মাসে অনেক অনেক কুরআন পড়তেন ও বুঝার চেষ্টা করতেন। এভাবে বিগত দেড় হাজার বছর ধরে রমাদ্বানের মাধ্যমে আল্লাহ মুসলিম উম্মাহ কুরআনকে যেমন উচ্চকিত করেছে, ঠিক তেমনি কুরআনের মাধ্যমে রমাদ্বানে প্রশিক্ষিত হয়ে এসেছে।
রমাদ্বানে প্রশিক্ষণের ক্ষেত্র সমূহঃ
আমরা এতক্ষণ প্রশিক্ষণ কিভাবে হয় তার আলোচনা করার প্রয়াস পেলাম। এখন আমরা কোন কোন ক্ষেত্রে আল্লাহ আমাদের প্রশিক্ষণ দেন সে ব্যপারে আলোচনা করার চেষ্টা করবো।
১- আধ্যাত্মিক প্রশিক্ষণঃ
আমার মনে হয় রমাদ্বানের সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়ে মানুষের মনোজগতে। তার মনে এনে দেয় আল্লাহভীতির এক ঐতিহাসিক পরম্পরা। সে জানে সিয়াম শুধু মাত্র তার জন্য আল্লাহর দেয়া আদেশ নয়। বরং এটা এসেছে আদম, শিস, নূহ, ইবরাহিম, দাঊদ, সুলাইমান, মূসা ঈসা হয়ে মুহাম্মাদ আলাইহিমুস সালাহ ওয়াসসালাম পর্যন্ত। এই ঐতিহাসিকতা তাকে দেয় অযুত প্রেরণা, করে তোলে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে আল্লাহকে কাছে পাওয়ার আগ্রহী। আল্লাহ তাআলা বলেছেনঃ كَمَا كُتِبَ عَلَى ٱلَّذِينَ مِن قَبْلِكُمْ অর্থাৎ যেমন ভাবে রোযা ফরদ্ব করা হয়েছিলো তোমাদের আগেকার উম্মাতদের।
একই ভাবে একজন মানুষকে দেয় জান্নাতের দিকে চলার স্থৈর্য ও হিম্মত। তাকে লক্ষ্য করেই যেন আমাদের মহানবী (সা) বলেছেনঃ صَوْمُ شَهْرِ الصَّبْرِ সবরের মাসের সিয়াম, অর্থাৎ রমাদ্বান মাসকেই সবরের মাস হিসেবে তুলে ধরা হলো। ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম মনে করেন এই মাসে একজন মানুষের দুইটা মানসিক শক্তি অর্জিত হয়, একটা সামনে চলার শক্তি, আরকেটা বিরত থাকার শক্তি। মানুষ যখন সকল প্রবৃত্তি ও মানসিক চাহিদার বিপরীতে চলার মত সবরের অধিকারি হয়, তখন সে ফিরিশতার গুণের সাথে যুক্ত হয়। কিন্তু উল্টোটা হলে যুক্ত হয় শয়তানের সাথে।
রমাদ্বানে তাক্বওয়ার হাট বসে, এখানে প্রতিটি পণ্যই মনে আল্লাহ ভীতি ছড়ায়, এবং তাকে আরশের দিকে ধাবিত করে। যা হলো আল্লাহকে হাজির নাযির জেনে আল্লাহভীরু হয়ে সোনার মানুষ হবারই নামান্তর।
ইখলাস বা নিষ্ঠা একজন মুমিনের বড় সম্পদ এবং তার আমল কবুলের বড় উপাদান। সিয়াম সাধনার মাধ্যমে তা খুব সহজে অর্জন হয়। এক হাদীসে কুদসিতে আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
كُلُّ عَمَلِ ابْنِ آدَمَ يُضَاعَفُ، الحَسَنَةُ عَشْرُ أَمْثَالِهَا، إلى سَبْع مِائَة ضِعْفٍ، قالَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ: إلَّا الصَّوْمَ؛ فإنَّه لي، وَأَنَا أَجْزِي به، يَدَعُ شَهْوَتَهُ وَطَعَامَهُ مِن أَجْلِي.
অর্থাৎ আদম সন্তানের প্রতিটি কাজের বদলা বহুগুণে বাড়ানো হবে। একটা ভালো কাজ দশগুণ থেক সাত শতগুণে বাড়িয়ে দেয়া হবে। আল্লাহ বলেন, তবে সাওম ছাড়া। কারণ তা শুধু আমার জন্যই। আর আমিই দেবো তার প্রতিদান। সে তার প্রবৃত্তি ও খানা ছেড়েছে আমার জন্যেই।
রমাদ্বানে সবচেয়ে বড় ট্রেইনিং হয় রাগ দমনের উপর। ক্ষুধার তীব্রতায় মানুষের রাগ অনেকাংশে বৃদ্ধি পায়। কিন্তু হাদীসে রাগ সম্বরণ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এমনকি সে মাযলুম হলেও এবং মানুষ তাকে গালি দিলেও, মারতে এলেও তাকে বলা হয়েছে, তুমি পালটা রাগ করোনা, মারামারিতে জড়িয়ে পড়োনা, বরং সেখানে বলে দাও, “তুমি একজন সিয়াম-সাধনাকারী”।
অশ্লীলতা মানুষকে পশুত্বে নামিয়ে আনে। অথচ তার বিপরীতে ভাষার সৌন্দর্য তাকে ফেরশতার কাতারে উন্নিত করে। চিৎকার চেচামেচি তাকে রাস্তার ছেলেদের কাতারে নিয়ে আসে। কিন্তু একমাস ধরে একজন সিয়াম সাধনাকারী পর্যায়ক্রমে এই পশুত্বের সারি থেকে সেরা মানবতার উন্নত শিখরে চলে আসে।
একজন সুস্থমতিত্বের অধিকারী মানুষ সভ্যতা সৃষ্টির অন্যতম অনুঘটক। রমাদ্বানের প্রশিক্ষণ তাকে তুলে ধরে মানসিক শান্তির হাইওয়েতে। তার ক্ষুধা হয় আল্লাহর গুনে সুবাসিত, তার ইফতার হয়ে ওঠে আল্লাহর কাছাকাছি হওয়ার আনন্দে মুখরিত, তার সালাত হয় আল্লাহর নৈকট্যের ছোঁয়ায় পুষ্পিত।
এমন একজন মানুষের সন্ধানে মানবতা খুঁজে ফিরে, যার মাঝে থাকে ভারসাম্যতা, থাকে সিদ্ধান্ত গ্রহনের ক্ষমতা, থাকে সেরা জিনিষ লাভের আকাংক্ষা, অথবা উঁচুতে ওঠার মানসিকতা। রমাদ্বান সেই লক্ষ্যে একজন মুমিনের সামনে খুলে দেয় জান্নাতের সেরা দরোযা, বন্ধ করে জাহান্নামের সাতটা দার, শৃংখলিত করে শয়তানের কুট চক্র। ফলে সে হয়ে ওঠে ভারসাম্যপূর্ণ। খাওয়া দাওয়ায়, চলা ফেরায়, ঘুমানোয় রাত্র জাগরণে, কথা বার্তায়, এবং আমল আখলাকে সে হয়ে ওঠে সেরা সৃষ্টির আদর্শ।
২- শারীরিক প্রশিক্ষণঃ
শরীরকে সুন্দর ও স্বাস্থ্যবান রাখতে রমাদ্বান বিশেষ ভূমিকা রাখে। এখানে একজন ব্যক্তি দিনের সূচনা থেকে রাতের প্রারম্ভ পর্যন্ত না খেয়ে, না পান করে, না যৌন সম্ভোগ করে থাকে। রাতে সে বিভিন্ন ইবাদাতে রত থাকে। পাঁচ ওয়াক্ত সালাত সঠিক নিয়মে ও নির্ধারিত সময়ে আদায় করে। তারাওয়ীহের সালাতে নিবিষ্ট হয়ে দীর্ঘ সময়ে শরীরের মুভমেন্ট বজায় রাখে। অনেক ক্ষণ না খাওয়ায় পাকস্থলী, ব্রেইন, রক্তের প্রবাহ ও চাপ, হার্টের বিট ও সঞ্চালন সবই একটা নিয়মের মধ্যে চলে আসে। এতে করে রমাদ্বান একজন মানুষকে শারীরিকভাবে অনেক ফিট করে তোলে।
৩- ব্যক্তিগত প্রশিক্ষণঃ
রমাদ্বান মাস একজন মানুষকে বিভিন্নমুখি প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। তাকে প্রথমেই সময়ানুবর্তি করে তোলে। মাস গণনায় তাকে সচেতন করে। প্রতিটি মানুষ যেন রামদ্বান মাসের চাঁদ সঠিক সময় দেখার চেষ্টা করে। এটা যাতে সঠিক হয় সে জন্য আগে পরের আরো মাসগুলো খেয়াল রাখতে বলেছেন আমাদের নবী (সা)।
দিনের শুরু, রাতের শুরু, সাহরির শেষ সময়, সালাতের সময়গুলো, শেষ দশ দিনের লায়লাতুল ক্বাদরের গণনা, শাওয়ালের চাঁদ, শাওয়াল থেকে হাজ্জের মাস সমূহের গণনা, প্রতি মাসের তিন দিন, ও প্রতি সপ্তাহের দুইদিন এই সব হিসেব তাকে রাখতেই হয়। এভাবে তাকে বানিয়ে দেয় এস্ট্রনোমার, বা জ্যোতির্বিজ্ঞানী।
দুনিয়ার ব্যাপারে তাকে মধ্যপন্থী মানুষ বানায়। আল্লাহ তাকে দিনের বেলায় তিনটি হালাল জিনিষ হারাম করে দিয়েছেন। আবার রাতের বেলায় ঐ তিনটি বিষয়কে আগের মত হালাল করে দিয়েছেন। স্ত্রী সম্ভোগ রাতে হালাল হলেও ইতিকাফ অবস্থায় তা আবারো হারাম করা হয়েছে। এইভাবে একজন মানুষের প্রশিক্ষণ চলতে থাকে।
সিয়ামের মাধ্যমে একজন ব্যক্তিকে রমাদ্বান প্রটেক্ট করতে চায়। তাকে বলে দেয়া হয়েছে, الصِّيَامُ جُنَّةٌ বা সিয়াম ঢাল। এই ঢাল একজন মানুষকে অবক্ষয়ের সমস্ত উপকরণ থেকে রক্ষা করে। তাকে দোযখের আগুন থেকে রক্ষা করবে। তাকে চারত্রিক ধ্বস থেকে বাঁচায়ে রাখবে। মিথ্যা, বেহায়াপনা, গালি গালাজ, পাপ, অশ্লীলতা থেকে দূরে রাখবে। তার দেহের প্রতিটি অঙ্গ ইবাদাতের বাইরে যেতে এই সিয়াম আটকে রাখবে। ইবনুল ক্বাইয়িম কত সুন্দরই না বলেছেনঃ আত্মা, মন ও মনন, এবং দেহের যাবতীয় রোগ থেকে সিয়াম ঢালের মত কাজ করে।
দেহের ইবাদাত, মনের ইবাদাত, মুখের ইবাদাতে রমাদ্বান একজন মানুষকে মশগুল রাখে হর-হামেশা। সম্পদ বিলিয়ে দিয়ে, চোখের পানির ঝর্ণা ঝরিয়ে, আল্লাহর ঘরে দিনের অধিকাংশ সময় কাটিয়ে, গোপনে আল্লাহর সাথে সময় দিয়ে একজন মানুষ আল্লাহর এত কাছে চলে যেতে পারে যে, রমাদ্বান শেষে সে জান্নাতের অধিবাসী হয়ে যেতেও পারে।
ইসলাম চায় একজন মানুষ ভালো হবে স্বেচ্ছায়। তার ভালো হওয়া কোন লোক দেখানো নয়, কারো ভয়ে নয়, বা আইনের চোখ রাঙানিতে নয়। সে ভালো, কারণ সে ভালোটাকেই গ্রহন করেছে। এই কারণের আল্লাহ তাকে নিয়ে গর্ব করেন, ফেরেশতার সামনে তাকে মডেল হিসেবে দেখান। রমাদ্বান সেই কাজটিই করে গোটা একমাস ধরে। এতে তার কোর্স পূর্ণ হয়, আল্লাহর মাহাত্ম্য গায়, এবং রব্বের শোকর আদায় হয়।
ইসলাম স্বার্থপর মুসলিম নিয়ে কোন কাজ করতে পারেনা। এইজন্য রমাদ্বানের মাধ্যমে তাকে আত্মোৎসর্গের চেতনায় উজ্জীবিত করে তোলে। সময়ের কুরবানী করে সে। অকাতরে অর্থ দান করে অহর্নিশ। ঘুম ও প্রবৃত্তির অনুশাসন থেকে সে সম্পূর্ণ স্বাধীন। চরম জুলুমের কাছেও নিজকে বিনয়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে সে। এ সবই একজন মানুষের আত্মোতসর্গের নমূনা।
একজন মানুষের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আসা অত্যন্ত উন্নত চরিত্রের লক্ষণ। রমদ্বানে একজন মানুষ দুনিয়ার সবচেয়ে হত ভাগা হতে পারে এই ইতিবাচক পরিবর্তনে ব্যর্থ হওয়ার কারণে। একবার জিবরীল (আ) এসে বললেন, হে নবী, যে ব্যক্তি রামদ্বান পেলো, অথচ তার গুনাহ মাফ করিয়ে নিতে পারলোনা, তার ধ্বংশ হোক, বলুন আমীন। আমাদের নবী (সা) বললেন, আমীন। আবার এই ধরণের আরেকজন ইতিবাচক পরিবর্তন এনে বিনা হিসেবে জান্নাতে যাবার উপযুক্ত হতে পারে।
আত্মমর্যাদাবোধ একটা জাতিকে অনেক উন্নত করে। এই যোগ্যতা না থাকলে তাদের দিয়ে সভ্যতা তো দূরে থাক একটা মর্যাদার ঘরও তৈরি করা যায় না। রমাদ্বান শেখায় কিভাবে আমরা ক্ষুদ্রতাকে ছাড়িয়ে উঠি। কিভাবে আমারা জান্নাতের দরোযা সমূহে নেত্রপাত করি। কিভাবে আমরা আল্লাহর সাথে মুলাক্বাত করি। কিভাবে তাঁর সাথে গোপনে কথা বলি। কিভাবে আমরা ফেরেশতার মর্যাদার কাছে দাঁড়াই। ফলে তারাই এসে আমাদের সাথে দেখা করে, সালাম দেয়। আর এই জন্যেই আমরা দেখতে পাই ইসলামের সবচেয়ে সঙ্গীন ও ইতিহাস পালটানো যুদ্ধগুলো হয়েছে রামদ্বানেই, এবং মুসলিমগণ বিজয় ছিনিয়ে এনেছেন দূর্দম সেনাবাহিনিদের পরাজিত করে।
একজন মানুষের পরিচয় হয় তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে। রমাদ্বান একজন মুসলিমকে চরিত্রের পোশাকে সাজিয়ে তোলে। তাকে মিথ্যা কথা বলতে দেয়না, জালিয়াতি করতে বাঁধা দেয়, তাকে গালি গালাজ নিষেধ করে, তাকে অশ্লীল হতে দেয়না। তাকে বলে দেয় তোমার সিয়াম সাধনা বৃথা হয়ে গেলো যদি তোমার চরিত্র ঠিক করতে না পারো। মহানবী (সা) বলেছেনঃ
ربَّ صائمٍ ليسَ لَه من صيامِه إلَّا الجوعُ وربَّ قائمٍ ليسَ لَه من قيامِه إلَّا السَّهرُ
অনেক রোযাদার আছে, যাদের ক্ষুধায় থাকা ছাড়া সিয়াম দিয়ে কোন কাজে আসেনা, আবার অনেক নামাযি আছেন, যারা রাত জাগা ছাড়া নামাযে কিছুই পায়না।
৪- পরিবার প্রশিক্ষণঃ
রমাদ্বান পরিবারের জন্য নিয়ে আসে জান্নাতি পরিবেশ। একজন সিয়াম সাধনাকারীর গোটা দিনের একটা বিশেষ অংশ কাটে নিজ সংসারের সদস্যদের সাথে। রমাদ্বানে আমাদের নবী (সা) পরিবারের জন্য আলাদা কোন প্রশিক্ষণ দিয়েছেন তার বর্ণনা আমরা তেমন পাইনা। তবে কুরআনের সূরাহ আল-বাক্বারার ১৮৭ আয়াতটি একান্তই পরিবার কেন্দ্রিক। এখানে কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছেঃ
একঃ রামদ্বানের সিয়াম প্রথম ফরদ্ব হওয়ার সময় আমাদের নবী (সা) এর মাধ্যমে রাতে খাওয়া দাওয়া বৈধ করা হলেও স্ত্রী সম্ভোগ বৈধ ছিলোনা। কিন্তু সাহাবিগণের কেও কেও এইটা কন্ট্রোল করতে পারেন নি, ফলে আল্লাহ তাআলা আগের হারামটা রাতের বেলায় বৈধ করে দেন। কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে স্বামী স্ত্রী একে অপরের ভুষণ। তাদের মিলন একেবারে প্রকৃতিগত।
দুইঃ স্বামী স্ত্রীর দৈহিক সম্পর্ক রমাদ্বানের রাতে বৈধ করার আরেকটি কারণ হলো রমাদ্বানের এই পবিত্র সময়ে স্বামী স্ত্রী যেন আল্লাহর লেখা ভাগ্য তারা অনুসন্ধান করে। অধিকাংশ মুফাসসির وَابْتَغُوا مَا كَتَبَ اللَّهُ لَكُمْ এই “লেখা ভাগ্য” বলতে সন্তান বুঝেছেন। এ থেকে ভালো একটা পথ দেখানো হচ্ছে যে, সন্তান লাভের উদ্দেশ্যে রমদ্বানের রাতগুলো স্বামী স্ত্রী ব্যবহার করতে পারে।
তিনঃ যেহেতু এই আয়াতটি পরিবার কেন্দ্রিক লেখা, আর একজন মানুষ রাতে স্বীয় বাসাতেই ঘুমায়, তাই সাহুরের প্রসঙ্গও এখানে এসেছে। সেটা হলো খাওয়া দাওয়া সংক্রান্ত নীতি মালা। খাওয়া ও পান করার বিষয়টা সুবহ সাদিক পর্যন্ত শেষ সময়। সেটাই আল্লাহ তাআলার নির্ধারিত হুদুদ বা সীমানা, যা লঙ্ঘন করা যাবেনা। এখানে খাওয়া ও পান করার ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ির কথাও অন্যত্র বলা হয়েছে।
كُلُواْ وَاشْرَبُواْ وَلاَ تُسْرِفُواْ
তোমরা খাও ও পান করো, তবে সীমা লঙ্ঘন করোনা। এটাই পরিবারের একটা ট্রেইনিং হওয়া উচিৎ।
চারঃ ই’তিকাফ ও এমন একটি ইবাদাত যা রামদ্বানে আল্লাহ করতে অনুপ্রাণিত করেছেন। আর এটা হলো ফ্যামিলি থেকে দূরে থেকে মসজিদে একাকি থাকার নাম। পরিবারকে মানসিক ভাবে এটাও প্রশিক্ষণ দেয়া উচিৎ যে তারা যেন পরিবার প্রধানের এই সুযোগ দানে কোন বাঁধা না হয়।
পাঁচঃ ই’তিকাফ করা অবস্থায় সুযোগ এলেও স্বামী স্ত্রীর দৈহিক মিলন বৈধ নয়।
রমাদ্বানে পরিবার কেন্দ্রিক আরেকটি বিষয় খুবই গুরুত্ব পূর্ণ, তাহলো, পরিবারের ছোট বাচ্চাদেরকেও সিয়াম সাধনায় উদ্বুদ্ধ করা উচিৎ। মহানবী (সা) এর যুগে বাচ্চাদের সিয়ামের প্রতি উৎসাহ দেয়া হতো। ওদের যখন ক্ষুধা ও পিপাসা লেগে যেতো, তখন তাদেরকে খেলনা দিয়ে ভুলিয়ে রাখা হত। এতে করে কখন ইফতারের সময় আসতো ওরা বুঝতে পারতো না। ফলে তাদের রোযা রাখায় কষ্ট কমতো। বাচ্চাদের এই ধরণের নির্মল আনন্দে ব্যস্ত রাখা হাদীস দ্বারা প্রমানিত।
এখানে আরেকটা বিষয় আমাদের নবী (সা) কখনোয় ভুলতেন না, তাহলো, রমাদ্বানের শেষের দশদিন তিনি পরিবারকে নিয়ে এক সাথে আমল বাড়াতেন। যাতে গোটা পরিবার ইবাদাতে শামিল হয়ে যেতো। ইসলামি জীবন যাত্রায় পরিবারের এই ধরণের ইবাদাত খুবই অর্থবোধক। এতে করে যেমন পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ় হয়, তেমনি ভাবে পরিবারের কাছে পরিবার প্রধানের রৌলমডেলিংটাও অত্যন্ত সুন্দর ভাবে ফুটে ওঠে।
৫- সমাজ প্রশিক্ষণঃ
ইসলাম সামাজিক রীতিনীতির এমন এক বন্ধন ও ইন্সটিটিউশনের উপর ভিত্তি করে গেঁথে তোলা, যার শক্তি অনেক, এবং মাঝে মাঝে সে শক্তি রাস্ট্রীয় শক্তির চেয়েও বেশি হয়ে যায়। রমাদ্বানে আমরা ইসলামের সেই শক্তিই অনেকটা দেখতে পাই। সামাজিক ক্ষেত্রগুলোতে রমাদ্বান এমন প্রভাব বলয় তৈরি করে যে, আমরা তার দ্বারা যেমন আপ্লুত হই, তেমন গর্বিত হয়ে উঠি। সমাজ জীবন তখনই সুন্দর হয় যখন এখানে প্রতিজন সদস্যের মাঝে সম্পর্ক থাকে নীবিড়। একে অপরের মাঝে ভালোবাসায়, দয়াদ্রতায়, হ্রদ্যতায় তারা যেন একটা দেহের মত হয়ে যায়। যখন দেহের একটা অঙ্গ ব্যথা পায় তখন সর্ব অঙ্গ জর ও নিদ্রাহীনতায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়। রমাদ্বান এসে এই ইসলামি সামাজিক জীবনে আরো গতি সঞ্চার করে। রমাদ্বান এসে এখানে ভ্রাতৃত্ববোধকে এমন পর্যায়ে নিয়ে আসে, যেন কেও কাওকে গালি না দেয়, অশ্লীল কথা না বলে, কেও কারো প্রতি রাগ না দেখায়। বরং সবার মধ্যে যেন সিয়ামের আবহ সঞ্চারিত হয় সেইজন্য সবাইকে উদ্বুদ্ধ করে।
সমাজের কেন্দ্রবিন্দু হলো মসজিদ। রমাদ্বানের প্রতি মুহুর্ত চলে এই মসজিদ কেন্দ্রিক। সালাতের জন্য নামে মুসল্লিদের ঢল, তারাওয়ীহের জামাআতে মানুষের সারি, কিয়ামুলায়লে অশ্রুসজল উপস্থিতি, ইফতারির জন্য আসে রকমারি ডিস। রমাদ্বান ঐক্যের সুত্র দেয়, সিয়াম একতার বিণ বাজায়, আর নর নারী, শিশু কিশোর, যুবক বৃদ্ধ, এবং নিশ্চিত ভাবে ধনী গরিবের মিলন মেলায় উদ্ভাসিত হয় সমাজের কেন্দ্রগুলোতে।
এখানে গোটা রমাদ্বানে কেও যেন অভুক্ত না থাকে তার জন্য ফিদইয়ার প্রচলন করা হয়েছে। যদি কেও রোযা রাখতে অপারগ হয়, সে কোন মিসকীন কে প্রতি রোযার বদলে একদিনের খানা খাওয়াবে। তাদের ইফতার খাওয়ানোর প্রতিও উৎসাহিত করা হয়। তাদের গরিবদের মাঝে যাকাত বন্টনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তারা সবাই যেন সুন্দর ভাবে এক সাথে আনন্দের মাঝে ঈদ করতে পারে এজন্য সাদাক্বাতুল ফিতরের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
রমাদ্বানের সামাজিক প্রশিক্ষণের সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক দৃশ্য ফুটে ওঠে ইসলামি সভ্যতাও সংস্কৃতির সব চেয়ে আনন্দময় ঈদে। ঈদকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে শপিং মল, ভরে যায় রকমারি খাদ্য, পানীয়, কাপড় চোপড় ও ঈদের গান ও কবিতায়। ঈদের জামাআত হয় মুসলিমদের সবচেয়ে উপভোগ্য সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জমায়েত। আমাদের নবী (সা) তাই এতে শিশু ও নারীদেরকেও সম্পৃক্ত করতেন। তিনি অন্দর মহলে অবগুণ্ঠনবতী মেয়েদের ও নিয়ে আসতে বলতেন, এমন কি মাসিকগ্রস্ত নারীদের নামায না থাকলেও ঈদের জামাআতে অংশ নিতে বলেছেন।
৬- রাস্ট্র ও বৈশ্বিক প্রশিক্ষণঃ
ইসলামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান হলো রাস্ট্রীয় পর্যায়ে দীন পালনের সুযোগ তৈরি করা। রমাদান এসে রাস্ট্রের বিভিন্ন দিকও বিভাগে ফেলে বিস্ময়কর প্রভাব। রমাদ্বান এসে রাস্ট্রকে দেয় অর্থ, দেয় জনগণের সাথে একাত্ম হওয়ার সুযোগ, খোলে বৈশ্বিক সংযোগ ও সম্পর্কের দরোযা। রমাদ্বান এসে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ইসলামের মূলনীতি তুলে ধরেঃ
يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ لَا تَأْكُلُوٓا۟ أَمْوَٰلَكُم بَيْنَكُم بِٱلْبَٰطِلِ إِلَّآ أَن تَكُونَ تِجَٰرَةً عَن تَرَاضٍ مِّنكُمْ ۚ
হে ঈমানদারগণ! তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না। কেবলমাত্র তোমাদের পরস্পরের সম্মতিক্রমে যে ব্যবসা করা হয় তা বৈধ। যদি মুনাফাখোরি হয়ে জনগণের উপর বাজার দর আগুণ করে দেয় তার জন্য রয়েছে মারাত্মক সাজা। মহানবী (সা) বলেছেন, যে দাম বাড়ানোর জন্য মুসলমানদের খাদ্য মজুদদারি করে আল্লাহ তাকে কুষ্ঠ রোগ ও দারিদ্র্য দিয়ে আঘাত করবেন।
রাস্ট্রের দ্বায়িত্ব হল রমাদ্বান শুরু ঘোষণা, ঈদের তারিখ ঘোষণা এবং মুসলিম জাতি সত্বাকে একতাবদ্ধ করে রাখা। সে ক্ষেত্রে আলিম উলামাদের ঐক্য ও সরকারি সংস্থা সমূহের মাঝে সুন্দর ব্যবস্থাপনা হওয়া উচিৎ।
রামাদ্বান ও ঈদকে কেন্দ্র করে যে অশ্লীলতার সয়লাব আজকের দুনিয়ায় মুসলিমদের হাতে ছড়িয়ে পড়েছে তা রোধ করা রাস্ট্রের তো দরকার ই, এমনকি সামগ্রিক পর্যায়ে সকল মুসলিমের উপরে এটা ফরদ্ব।
রমাদ্বান এসে আমাদের নানামুখি প্রশিক্ষণ দিয়ে আল্লাহর প্রিয়পাত্র হবার সুযোগ করে দেয়। আমরা দুয়া করি আল্লাহ যেন এবারের রমাদ্বান আমাদের সেই পথে প্রধাবিত করে এবং জান্নাতের রায়্যান গেইট আমাদের জন্য অবধারিত করে দেন। আমীন।